সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। শহর থেকে শুরু করে গ্রাম অঞ্চলেও ছোঁয়া লেগেছে তথ্যপ্রযুক্তির। তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুফল ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যোগাযোগের নতুন মাত্রা সৃষ্টি হয়েছে।
বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে এখন প্রায় অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা ইন্টারনেটের সুবিধা পেয়ে আসছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে সরকার সবক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করার লক্ষ্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সাফল্যও কম নয়। ইন্টারনেটের কারণে সবকিছু এখন হাতের নাগালে। বর্তমান সরকার তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ইন্টারনেটের ব্যবহার পৌঁছে দিচ্ছে। এর সুফলের মাধ্যমে স্বচ্ছতাও সৃষ্টি হচ্ছে অনেকখানি।
স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, ইমো, ইউটিউব, জি-মেইল, মেসেঞ্জার- এ সংক্রান্ত অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া একটি দিন অতিবাহিত করা প্রায় অসম্ভব।
ইন্টারনেট আমাদের জীবনকে করেছে সহজ। ঘরে বসে ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা, ভ্রমণের টিকিট প্রাপ্তি, পরীক্ষার ফল পাওয়া, করোনা মহামারিতে শিক্ষার ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাওয়াসহ যাবতীয় তথ্য জানা যাচ্ছে। কোনো আবিষ্কারের সুফল বা কুফল নির্ভর করে মানুষের ওপর। প্রতিটি আবিষ্কারের ভালো ও খারাপ উভয় দিকই আছে। বর্তমানে তরুণ সমাজ সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। কিন্তু এর অপব্যবহারের কারণে দ্রুত ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজ। পিতামাতা বা অভিভাবকের অবহেলার কারণে শিশুরা খুব কম বয়সে বিভিন্ন গেমে আসক্ত হচ্ছে। আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।
আমাদের দেশসহ বিশ্বে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে প্রযুক্তির অপব্যবহারকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা। অন্যদিকে করোনাকালে ডিভাইস নির্ভরতা, পারিবারিক বন্ধন কমে যাওয়া এবং সন্তানদের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ববোধের অভাব বাড়িয়ে দিয়েছে সামাজিক অপরাধ।
নারীর চরিত্র হনন, ধর্ষণের দৃশ্য নেটে ছেড়ে দিয়ে নারীকে আত্মহত্যার পথে ধাবিত করা হচ্ছে। জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদিতা সাইবারের মাধ্যমেই ছড়াচ্ছে। শিশুরা অল্প বয়সে চোখের সমস্যায় ভুগছে, মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। খেলাধুলা না করার কারণে শিশুরা অল্প বয়সে মুটিয়ে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
তরুণ সমাজ সাহিত্যচর্চার দিক দিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন আর বাসে বা ট্রেনে উঠলে দেখা যায় না কাউকে পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পড়তে। সবাই স্মার্ট ফোন নাড়াচাড়া নিয়ে ব্যস্ত। সমাজ ও অপরাধ গবেষকেরা বলছেন, সংস্কৃতিচর্চার অভাব, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, করোনাকালে ডিভাইস ও ইন্টারনেটের ব্যবহার আর প্রযুক্তিতে সরকারের যথেষ্ট নজরদারির অভাব বাড়িয়েছে অপরাধকর্ম। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে শৈশব থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইট বা অ্যাপের প্রতি নতুন প্রজন্মের বাড়ছে আসক্তি।
প্রযুক্তির অপব্যবহার ঠেকাতে রাষ্ট্রকে রাখতে হবে মূল ভূমিকা। সাথে অভিভাবকসহ সবারই দায়িত্ব রয়েছে। নেগেটিভ সাইটগুলো বন্ধ করতে হবে। সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ববোধের পাশাপাশি প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সজাগ থাকতে হবে। তাহলে প্রযুক্তি হবে আগামী প্রজন্মের আশীর্বাদ। অন্ধকারে আলোকিত পৃথিবী দেখা এবং ঘুম ঘুম চোখে রঙিন দুনিয়ায় প্রবেশ ইত্যাদি তারুণ্যকে ক্রমেই ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইন্টারনেট আসক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে বলেন যে, মাদকের পরিবর্তিত সংস্করণ হচ্ছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বা ইন্টারনেটে অকারণে অতিমাত্রায় আসক্তি। দেখা যায়, খেলা বা অন্যকিছুকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত চরিত্র হননে লিপ্ত থাকেন, পারস্পরিক মতামতে অসহিষ্ণু বা অযথা ইস্যু তৈরি করে বিভিন্ন দাঙ্গার সৃষ্টি করে। শহরের, গ্রামের কিশোর বয়সিরা মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদি বিষয়ে জানা এক একটা সময়ের তারকা এক্সপার্ট। আশ্চর্য হলেও সত্য, ড্রইং, কবিতা, আবৃত্তি, গান, নাচ, অভিনয় শিখতে কোনো প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। কিন্তু কম্পিউটারের অফিস প্রোগ্রামটি একবার কিশোরদের হাতে পড়লেই বাকিগুলো আর শিখতে বেগ পেতে হয় না, শিক্ষকের প্রয়োজন হয় না। অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, ধর্মীয় চিন্তাবিদ সবাইকে যে যার জায়গা থেকে ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধে সোচ্চার হতে হবে। সরকারকে এর অপব্যবহার রোধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি, অতিমাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা বা আসক্তি রুখতে হবে।