বাংলা ভাইয়ের জঙ্গি দলে যারা ছিল, তারা মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্র ছিল। অন্য কথায়, জঙ্গি বলতে আমাদের মনে সাধারণত গরিব ঘরের মাদ্রাসাছাত্রের ছবিই ভেসে ওঠে। কিন্তু হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় যে জঙ্গিরা মারা পড়ল, তারা প্রায় সবাই ঢাকার অভিজাত মহল থেকে আসা তরুণ। তারা ইংরেজি মাধ্যম ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মানুষ।
তবে এই দুই ঘরানার জঙ্গিদের মধ্যে একটি মিল আছে, সেটা হলো তারা কেউই সমাজের মূল ধারার মানুষ নয়। মূল ধারার নয় এ অর্থে যে তারা মূল ধরার বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা মানুষ নয়। অর্থাৎ, সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যে কারিকুলামে পড়াশোনা করে, তারা সেটা পড়েনি, যে কারিকুলাম সাধারণত সরকার নির্ধারণ করে। মাদ্রাসার মধ্যে কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা সরকারের কাছ থেকে অনুদান পায় না। তারা কী পড়ায় না-পড়ায়, সেটাও সরকার দেখে না। ইংরেজি মাধ্যমের (ব্রিটিশ কারিকুলাম) ব্যাপারেও সরকারের ভূমিকা নেই। সেখানে যা পড়ানো হয়, তার সঙ্গে এ দেশের মাটির যোগ নেই। অন্যদিকে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত বাজারমুখী বিষয় পড়ানো হয়।
ওপরে এসব তথ্য দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো এটা দেখানো যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বড় ধরনের গলদ রয়েছে, যেটা নানাভাবে মানুষকে চরমপন্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বাজারমুখী বিবিএ, এমবিএ অথবা প্রযুক্তির বিষয়গুলোতে সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হয় না। ফলে এই ছাত্রদের শিক্ষা খুবই একমুখী হয়ে যাচ্ছে। তারা শ্রেণিকক্ষের বাইরে সমাজ ও জগৎ নিয়ে পড়াশোনা করছে না। আবার মাধ্যমিক শিক্ষা থেকেও আমাদের ছাত্ররা জীবন-জগৎ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা পায় না। তার সঙ্গে তো ছাত্রদের ব্যক্তিগত হতাশা বা ক্ষোভের জায়গা আছেই। এই খণ্ডিত শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের চরমপন্থার দিকে ধাবিত করা সহজ, অন্তত তথ্য-প্রমাণ সেই সাক্ষ্যই দিচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান পড়ানো হয়। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসবের বালাই নেই। সেখান থেকে পাস করা একজন প্রকৌশলী বা বিজনেস গ্র্যাজুয়েটের যদি ধারণাই না থাকে সমাজ ও রাষ্ট্র কীভাবে গঠিত হয় আর কীভাবেই তা পরিচালিত হয়, তাহলে সে শিক্ষার কী মূল্য থাকে। আবার সে যদি শিল্প-সাহিত্য পাঠ না করে, তাহলে তার সুকুমার বৃত্তিইবা কীভাবে গড়ে উঠবে, যে বস্তুর অভাব থাকলে মানুষের মধ্যে পাশবিকতা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তখন তার পক্ষে মানুষ খুন করা সম্ভব। আবার এসব জানা মানুষ যে মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ খুন করেনি, তাও নয়। কিন্তু জীবন-জগৎ সম্পর্কে সার্বিক ধারণা থাকলে মানুষের চরমপন্থার দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে। কারণ, বিদ্যমান ব্যবস্থার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে বদলানোর অভিপ্রায়ে একটি ছেলে জঙ্গি হচ্ছে। তার সামনে যদি বিকল্প ভাষ্য থাকত, তাহলে হয়তো সে এ পথে যেত না।
শিক্ষার পাশাপাশি সমাজে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কমে যাওয়াটাও জঙ্গিবাদের উত্থানের আরেকটি কারণ। অবসর সময়ে তরুণেরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত হলে তাদের মধ্যে হতাশা বা শূন্যতা বোধ সৃষ্টি হতো না। সেটা একরকম উঠে যাওয়ার কারণে সমাজে যেমন একধরনের উগ্র তারুণ্য দেখা যাচ্ছে, তেমনি তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এসব দূর করার জন্য একদল তরুণ ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একদল ক্যারিয়ার নিয়ে মাতাল, আরেক দল জিহাদের পথে। তাই মোদ্দা কথা হলো, জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমাদের সুদূরপ্রসারী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা আন্দোলনে নামতে হবে।