দুর্নীতি হচ্ছে দেশ ও জাতির জন্য ক্যান্সারের মতো। ক্যান্সার যেমন মানবদেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আস্তে আস্তে ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনি দুর্নীতিও একটি জাতির সব সম্ভাবনা তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়। দুর্নীতির সীমা-পরিসীমা অত্যন্ত ব্যাপক এবং বিস্তৃত। ঘুষ, চুরি, আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, পক্ষপাত, স্বজনপ্রীতি সবই দুর্নীতি। ঘুষ ছাড়া একজন কর্মকর্তা কাজ করেন না এটা যেমন দুর্নীতি, তেমনি কলমের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে কাউকে কিছু দেয়াটাও দুর্নীতি। ক্ষমতার অপব্যবহার করাটাও দুর্নীতি। ন্যায়বিচার না করাও দুর্নীতি, আবার বিচার বিলম্বিত করাও। অন্যায়ভাবে টেন্ডার আয়ত্ত করাটা যেমন দুর্নীতি, ঠিক তেমনি ওজন এবং পরিমাপে কম দেয়াও দুর্নীতি। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেয়া, পণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য পণ্য মজুদ করা, দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া, অন্যকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যথাযথ ট্যাক্স না দেয়া, ট্যাক্স যথাযথ আদায় না করা, সত্য কথা না বলা, মিথ্যা বলা, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া এবং মিথ্যা রিপোর্ট লেখা এসবই দুর্নীতি। ওয়াদা রক্ষা না করা, আমানতদারি ভঙ্গ করাও দুর্নীতি। এতসব দুর্নীতি থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য দরকার সম্মিলিত প্রয়াস।
চরিত্র মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষের যখন চারিত্রিক গুণাবলি ধ্বংস হয়ে যায়, তখন সে শুধু অপকর্ম করতে থাকে। দুর্নীতিই হয়ে ওঠে চরিত্রহীন মানুষের প্রধান কাজ। ইংরেজিতে প্রবাদ আছে, When money is lost nothing is lost, when health is lost something is lost, but when character is lost everything is lost. সত্যি সত্যি চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে আজ আমাদের সবই নষ্ট হয়ে গেছে। তাই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জাতির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। আর এ জন্য দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। কিন্তু কেবল আইন করে এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে দুর্নীতি নির্মূল করা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন সম্ভব নয়। দুর্নীতি নির্মূল ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করতে প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত সৎ মানুষ। কারণ আইনের প্রয়োগ যিনি করবেন, তিনি যদি সৎ না হন তাহলে সেখানে আইন যথাযথ কার্যকরী হয় না। একটি গাড়ি যতই ভালো হোক না কেন, ড্রাইভার যদি ভালো না হয় তাহলে সে গাড়ি যাত্রীদের জন্য বিপদ আনতে পারে। তেমনিভাবে আইনের প্রয়োগকারী ব্যক্তি যদি সৎ এবং নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে সেই আইন ও মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। বরং সে ক্ষেত্রে আইনের অপপ্রয়োগ হয় এবং সেই আইন মানুষের জন্য অকল্যাণই বয়ে আনে। সুতরাং আইন দ্বারা যদি আমরা ন্যায়বিচার আশা করি, তাহলে সে ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিকে আইনের যথাযথ এবং সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিটি সৎ হবে। সুতরাং দুর্নীতিমুক্ত সমাজের জন্য, শান্তি এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্য সৎ মানুষ অপরিহার্য। আর এজন্য সৎ মানুষ তৈরি করতে হবে এবং এর কোনো বিকল্পই নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য আমরা যথেষ্টসংখ্যক সৎ মানুষ তৈরি করতে পারিনি এবং এখনো করছি না। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কথায় কথায় দুর্নীতিমুক্ত এবং সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার কথা বললেও, সেই সোনার বাংলা গড়তে যেসব সোনার মানুষ অর্থাৎ সৎ মানুষ দরকার তা তারা তৈরি করেনি। ফলে দেশে আজ সৎ মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, দুর্নীতি বেড়ে যাচ্ছে এবং সমাজে অশান্তি বাড়ছে।
সৎ মানুষ তৈরির দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সবার। প্রথমত কাজটা শুরু করতে হবে সমাজের একেবারে প্রাথমিক স্তর পরিবার থেকে। আর পরিবারের মূল ভিত্তি হচ্ছে মা ও বাবা। সুতরাং পিতা-মাতার দায়িত্ব হচ্ছে সন্তানকে ছোট বয়স থেকেই সততা, নৈতিকতা এবং ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দেয়া। তবে বাবা যেহেতু বেশির ভাগ সময় বাসার বাইরে থাকেন, সেজন্যে এ ক্ষেত্রে মায়ের দায়িত্ব কিছু বেশি। এ জন্য বিখ্যাত ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছিলেন, আমাকে একটি ভালো মা দাও, আমি তোমাদের একটি ভালো জাতি দেবো। পিতা-মাতা কিন্তু তাদের সন্তানকে ঠিকই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার যাবতীয় চেষ্টা করছেন, চাকরি অথবা ব্যবসার মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, কিন্তু এর পাশাপাশি নৈতিকতা, সততা এবং উত্তম চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনের শিক্ষা দিচ্ছেন না। ফলে সন্তানরা ঠিকই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছে, চাকরি অথবা ব্যবসা বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং একই সাথে চারিত্রিকভাবে সৎ না হওয়ায় দুর্নীতিও করছে। যে সন্তানের সৎ জীবনযাপন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার কথা ছিল, সেই সন্তানই হয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজ এবং দুর্নীতি বিস্তারের সৈনিক।
আমরা নিজের সন্তানদের নিজ নিজ ধর্ম শিক্ষা দিতে পারি, কারণ প্রত্যেক ধর্মই দুর্নীতিমুক্ত, সৎ জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ছাত্ররা যাতে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন হয়ে গড়ে ওঠে, সেজন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনতে হবে এবং চারিত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শিক্ষককে বলা হয় দ্বিতীয় জন্মদাতা। সৎ ও আদর্শ নাগরিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। যদি পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতার শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং শিক্ষকরা যথাযথভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন তাহলে অতি সহজেই একদল সুযোগ্য এবং সৎ নাগরিক গড়ে উঠবে, যারা প্রতিষ্ঠিত হয়ে সৎ জীবনযাপন করবে ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করবে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে করে দলের কর্মীরা সততা এবং নৈতিকতার শিক্ষা লাভ করে। দেশের ব্যাপকসংখ্যক মানুষের ওপর রাজনৈতিক দলের সরাসরি প্রভাব থাকে এবং রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র ও দলের কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীরা প্রভাবিত হয়। সুতরাং যেই দলের নেতারা সৎ নয়, সেই দল ও দলের নেতাকর্মীদের দিয়ে সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া সম্ভব তো নয়ই বরং তাদের হাতে সমাজে দুর্নীতিই প্রতিষ্ঠিত হবে। চতুর্থত দেশের সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে নৈতিকতার আলোকে সমৃদ্ধ করতে হবে। নাটক সিনেমা হচ্ছে সমাজের দর্পণ, সমাজ পরিবর্তনের ও নির্মাণের উৎকৃষ্ট হাতিয়ার। এমন নাটক এবং সিনেমা তৈরি করতে হবে যাতে করে এসব নাটক এবং সিনেমা দেখে মানুষের মধ্যে সততা এবং নৈতিকতা জেগে ওঠে। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে বর্তমানে যে চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে তার প্রধান বিষয় হচ্ছে ভায়োলেন্স, অশালীন নৃত্য ও কুরুচিপূর্ণ গল্পকাহিনী। এসব দেখে আমাদের উঠতি বয়সের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে অশ্লীলতা খুব বেড়ে গেছে। অধিকন্তু পরিবারের সবাইকে নিয়ে নাটক, সিনেমা দেখার পরিবেশ তো বহু আগেই বিদায় হয়েছে। আমরা সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিমুক্ত ও সুন্দর সমাজ নির্মাণ করতে চাই, তাহলে নাটক সিনেমায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। আর তার জন্য নাটক ও চলচ্চিত্র থেকে ভায়োলেন্স ও অশালীনতা দূর করতে হবে এবং তৈরি করতে হবে মূল্যবোধে উজ্জীবিত সুস্থ ধারার নাটক ও চলচ্চিত্র।
সর্বোপরি দুর্নীতি, অসততা এবং অনৈতিকতার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজের যে ব্যক্তিই দুর্নীতি করুক না কেন, তাকে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। আর এভাবেই কেবল দুর্নীতির মূলোৎপাটন ও সৎ মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
শরীরে অসুখ হবার পর চিকিৎসা করে সুস্থ হবার চেয়ে অসুখকে প্রতিরোধ করাই উত্তম এবং এটাই সঠিক পথ। সুতরাং আমাদের স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চলতে হবে এবং এরপরও যদি শরীরে অসুখ হয়ে যায় তাহলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। শরীর সুস্থ রাখার এই পদ্ধতি কিন্তু আমরা কম বেশি সবাই জানি এবং মেনে চলতে চেষ্টাও করি। একইভাবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাইলে দুর্নীতির প্রতিরোধ জরুরি। রোগ প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করে শুধু চিকিৎসার মাধ্যমে যেমন রোগ কখনোই নির্মূল করা যায় না, ঠিক তেমনিভাবে সৎ মানুষ তৈরি না করে শুধু দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে কিছুতেই দুর্নীতি দমন করা যাবে না। সুতরাং দুর্নীতি দমনের জন্য সৎ মানুষ তৈরির বিকল্প নেই। মহানবী সা: বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে চারিত্রিক গুণাবলির দিক দিয়ে উত্তম।
একটি জাতিকে রক্ষার জন্য একটি প্রজন্মকে রক্ষা করো। আমরা যদি একটি সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারি, তাহলে সেই প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মকে সৎ এবং দুর্নীতিমুক্ত হিসাবে গড়ে তুলবে। এভাবে ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে একদিন পুরো জাতিই সৎ ও দুর্নীতিমুক্ত হবে।
পৃথিবীর কোনো মহৎ সৃষ্টিই এক দিনে হয়নি। কোনো শহর যেমন এক দিনে গড়ে ওঠেনি, তাজমহল যেমন এক দিনে তৈরি হয়নি, কোনো সভ্যতা যেমন এক দিনে সৃষ্টি হয়নি, ঠিক তেমনি কোনো জাতিও এক দিনেই শিক্ষিত ও সভ্য হয়নি। যে বাড়িতে আমরা বসবাস করি, যেই রাস্তা দিয়ে আমরা চলাচল করি, যে গাছের ফল আমরা খাই, জীবনযাত্রার যেই আধুনিক সুবিধা আমরা ভোগ করিÑ তার সবই আমাদের পূর্বসূরীদেরই তৈরি। তারা তৈরি করেছিলেন বলেই তাদের পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে আমরা তা ভোগ করছি। সুতরাং আমাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য আমাদেরই কাজ করতে হবে। সর্বশেষে মহানবী সা:-এর একটি কথা বলে এই নিবন্ধের ইতি টানছি। তিনি বলেছেন, যার আজকের দিনটা গতকালের চেয়ে উন্নত হলো না, তার জন্য ধ্বংস অনিবার্য। এ কথাটি সমাজের সব সেক্টরে সমভাবে প্রযোজ্য। কারণ প্রত্যেকের অবস্থান সময়ের সাথে সাথে আরো উন্নত হতে হবে, তা না হলে অধঃপতনে যে কোনো অবস্থান একদিন ধ্বংস হবে। সুতরাং যদি আমরা নিজেরা সৎ হই এবং অন্যদের সৎ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তাহলে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের উন্নতিও অনিবার্য।