Blog

ধর্মীয় উগ্রতার পিছনে থাকে ফিক্সড মাইন্ডসেট

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় ছয় বছর পূর্ণ হলো। গত ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা কুপিয়ে ও গুলি করে ২০ জন দেশি-বিদেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাও নিহত হন। এঘটনায় প্রমাণীত হয়েছে, শুধু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় না, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতরাও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। এই জঙ্গিবাদী চেতনায় আক্রান্ত হওয়ার পিছনে থাকে ফিক্সড মাইন্ডসেট( Fixed mindset), তথা সীমাবদ্ধ চিন্তার ভূমিকা।
মাইন্ডসেট সাধারণত দুই প্রকারের হয়ে থাকে; ফিক্সড মাইন্ডসেট (Fixed mindset) ও গ্রোথ মাইন্ডসেট ( Growth mindset)। যে ব্যক্তি কোনো যুক্তি বিশ্বাস করে না, নিজের বিশ্বাসে অটল থাকে এবং নিজের ধর্মের বাইরের লোকদের শত্রু মনে করে, তাকেই ফিক্সড মাইন্ডের লোক হিসেবে গণ্য করা যায়। মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণীর মস্তিষ্ক ফিক্সড (নির্দিষ্ট)। যেমন, মৌমাছি ও বাবুই পাখি যতোই সুন্দর ও শৈল্পিকভাবে বাসা তৈরি করুক না কেন, তারচেয়েও সুন্দর বাসা তৈরি করতে তারা অক্ষম। আমরা জানি কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি তীব্র ও তারা অত্যন্ত প্রভুভক্ত। কিন্তু তাদের এ গুণাবলিও নির্দিষ্ট। অর্থ্যাৎ তাদের মস্তিস্ক ফিক্সড( Fixed)। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট গন্ডি পেরিয়ে নতুন কিছু জানতে চায়, নতুন কিছু আবিস্কার করতে চায়। সেজন্য তাদের চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতার প্রয়োজন পড়ে ৷ যে সমাজ কিংবা রাষ্ট্র মানুষের বহুমুখী চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয় সেসকল রাষ্ট্রে কবি-সাহিত্যিক- দার্শনিক- বিজ্ঞানী জন্মলাভ করে বেশি( যেমন, ইউরোপিয়ান দেশগুলো)। প্রতিটি মানুষ বন্য ও বর্বর চরিত্র নিয়ে জন্মলাভ করে। তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা থাকে( লক্ষ্যনীয়, গ্রাম কিংবা বস্তি এলাকায় যেসব যুবকরা শিক্ষা বঞ্চিত, তাদেরকে যৌনমনস্কতা সহ বিভিন্ন অপরাধ প্রবণতায় ভুগতে দেখা যায়)। তাছাড়া মানুষের মস্তিস্ক নতুন কিছু জানার জন্য উন্মুখ থাকে। অর্থ্যাৎ মানুষের মস্তিস্ক নতুন নতুন তথ্য নেয় এবং বৃদ্ধি ( Growth) ঘটে, তথা বিকাশমান থাকে।

মানুষ যদি তার মস্তিককে বৃদ্ধি না ঘটিয়ে ফিক্সড রাখে তাহলে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে তার কোনো প্রভেদ থাকে না। কেউ চান না তার সন্তান তার মতো থাকুক। প্রত্যেকেই চান তার সন্তান উন্নত কিছু করে সকলের মুখ উজ্জ্বল করুক। সেজন্য অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান। এখন প্রশ্ন হলো, হলি আর্টিজান বেকারিতে আক্রমণকারী যুবকদের পরিবার তো শিক্ষিত এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছে, তাহলে তারা কেন ফিক্সড মাইন্ডেড হয়ে গেল? যেসব যুবক মাদ্রাসায় কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে, সেসব যুবকদের মাইন্ড ফিক্সড রাখা সহজ হয়। আর যারা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে তাদের বেলায় সময় দিতে হয় বেশি৷ যেমন, আক্রমণকারী যুবকদের মধ্যে তিনজন ছিল নর্থ- সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। জানা গেছে, তাদের মাইন্ড ফিক্সড করার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের ভূমিকা ছিল( ওই শিক্ষক বর্তমানে পলাতক রয়েছেন)। দেশের অধিকাংশ জনগণ যদি ফিক্সড মাইন্ডের হয়ে যায়, তাহলে চুড়ান্তভাবে লাভবান হবে মৌলবাদী দলগুলোই( সেজন্য কয়েকটি চক্র দেশব্যাপী টিমওয়ার্ক চালু রেখেছে) । এ সুযোগে অন্যান্য দলগুলোর নেতাকর্মীরাও লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। এখানে গত ১৮ জুন’ ২২ তারিখে সংঘটিত নড়াইল জেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ঘটনাটি উদাহরণ হতে পারে। সেখানকার আওয়ামীলীগ নেতা ও একই কলেজের শিক্ষক আকতার হোসেন টিংকু অধ্যক্ষ হওয়ার অভিপ্রায়ে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আনীত ধর্মীয় অবমাননার মিথ্যা অভিযোগটি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। তাকে পাশে দাড়িয়ে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে উৎসাহ দিতে দেখা গেছে। আরও দেখা গেছে, প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ সদস্য উপস্থিত থাকার পরেও কয়েক’ শ বিক্ষুব্ধ( বলা উচিত ফিক্সড মাইন্ডের) লোক অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিচ্ছে( তবে সেখানকার ডিসি-এসপি’র বক্তব্য তাঁরা কলেজ আঙ্গিনায় পৌঁছানোর আগেই জুতার মালা পরানোর ঘটনা ঘটে গেছে)। তাছাড়া বর্তমানে আরেকটি ঘটনা বিশেষভাবে লক্ষনীয় তাহলো- দলীয় নেতাকর্মীরা মসজিদ কমিটি, গোরস্থান কমিটি, ঈদগাহ কমিটি, মাদ্রাসা কমিটি ইত্যাদি দখলে নেয়ার জন্য তাদের সহযোগিতা নিচ্ছে । জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পিছনে আরও কারণ রয়েছে।
গত ১ জুলাই দৈনিক সমকালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, ৮৩% জঙ্গি উত্তরবঙ্গের৷ তাদের অর্ধেকই নিম্নবিত্তের( জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ ৫০.২৮% রাজশাহী ও ৩২.৯% রংপুর জেলার)। সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক এ প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘বিদ্যমান সমাজকাঠামোর প্রতি নিম্নবিত্তদের ক্ষোভ থাকে, সমাজ-বিচার ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার চিন্তা তারা সহজেই লুফে নেয়।’ মেজর জেনারেল( অব.) আবদুর রশীদ বলেছেন- জঙ্গিবাদ যারা মস্তিষ্কে ধারণ করেছে, তাদের মস্তিস্কে সম্প্রীতির আদর্শ প্রতিস্থাপন করতে না পারলে জঙ্গিবাদ বেঁচে থাকবে’ ( সমকাল, ১ জুলাই’২২)। সেজন্য দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভর একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক, তথা জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা চালু করতে হবে। অর্থ্যাৎ দেশের নাগরিকদের বুঝাতে হবে- মানুষ নিজেই তার কর্মের কাছে দায়ী, নিজেই ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। দেশের মঙ্গল কিংবা অমঙ্গল করার ক্ষমতা মানুষের রয়েছে। পৃথিবীর যতো উন্নয়ন হয়েছে তা মানুষই করেছে, অলৌকিকভাবে কিছু ঘটেনি , আগামীতেও ঘটবে না।

Share on facebook
Facebook
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed By : F.A. Creative Firm Ltd.