বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে দু’টি ধারা পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ, যেমন সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ ও ২ক অনুচ্ছেদ একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। যেখানে সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি, কিন্তু ২ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন, যা পরিপূর্নভাবে নিরপেক্ষতার সাথে সাংঘর্ষিক। যার ফলে, আমাদের রাজনীতিবিদরাও সুবিধামতো শব্দ ব্যবহার করেন৷ কখনো বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ, আবার কখনো বলেন মুসলিম রাষ্ট্র।
যার ফল স্বরূপ ধর্মভিত্তিক দল গুলো ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করছে। উদাহরন স্বরূপ বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, জঙ্গি হামলা, ব্লগার হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড এবং রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিষেশ দৃষ্টি কেড়েছে।আজ পর্যন্ত কোন ব্লগার হত্যার বিচার হয়নি এদেশে। যার জন্য আমরা একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করেছি৷
এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০.৪% মুসলমান ও সবাই সাধারণভাবে ধর্মপরায়ণ, কেউ কেউ অবশ্য কট্টরপন্থি৷ যার ফলে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরে উগ্র মৌলবাদ এখন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা। আর এই মৌলবাদ উগ্রবাদে, এবং উগ্রবাদ জঙ্গিবাদে রূপ নিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি জঙ্গিবাদ বিস্তারের আতুর ঘর। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো সমাজে জঙ্গিবাদের শিকড় খুব গভীরে, ভারতেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কারণে গুজরাটের দাঙ্গা এবং অতিসম্প্রতি সংখ্যালঘু মুসলিম এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপর হামলা। যার প্রভাব বাংলাদেশের মত ছোট দেশেও চরম ভাবে বিদ্যমান।
গবেষনায় বলে, একটি দেশের সরকারের যখন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বিরোধীদের মত প্রকাশের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে তখনই এ ধরনের সহিংসতা বেড়ে যায় ও জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। এদেশের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে জঙ্গিবাদ আবর্তিত হয়েছে কার্যত ‘রাজনীতিকে কেন্দ্র করেই।
বাংলাদেশের জঙ্গি রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৮০ সাল থেকেই কিছু উগ্র ধর্মীয় সংগঠন তাদের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পরিচালনা করে আসছে।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৯ সালঃ অনেক বাংলাদেশি মুজাহিদিন আফগানিস্তানে গিয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। যুদ্ধ সমাপ্তির পর তারা দেশে ফিরে আসলে তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের মত একটি শরিয়াভিত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, তাদেকে সেসময় ডানপন্থী রাজনীতির আদর্শিক বন্ধু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকার মদদ দিয়েছিল।
মজার ব্যাপার হল, বহু বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের শাসনামলে কোনো শক্তিশালী উগ্রবাদী কার্যক্ষম লক্ষ্য করা যায়নি। এর পেছনে প্রধান দুটি কারণ হল, একঃ আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে দেশীয় মুজাহিদিনরা আফগানিস্তানের মুজাহিদিনদের পক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, যার ফলে ১৯৮৯ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোনো ধরনের উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড দেখা যায়নি। দুইঃ জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে অভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন করে আসছিল। যার ফলে বড় দুটি দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমন্বয় থাকায় ধর্মীয় উগ্রবাদ ততটা লক্ষ্য করা যায়নি।
পরবর্তিতে ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সালের পর্যন্ত জঙ্গিবাদের ভয়াবহ রূপ দেখেছে বাংলাদেশ। সে সময় যে সকল জঙ্গি সংগঠন অবাধে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করেছিল, তাদের মধ্যে চারটি জঙ্গি গোষ্ঠী বেশি আলোচিত ছিল যেমন, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদুল ইসলামী ও হিজবুত তওহিদ। তূখন যত্রতত্র বোমা হামলায় মারা গেছে অসংখ্য মানুষ।বাংলাদেশে তখন এই জঙ্গিবাদের উত্থানের জন্য তৎকালীন বিএনপি-জামাত জোট সরকারে জঙ্গিবান্ধব মনোভাব এবং অনেকে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সহায়তাকেই দায়ী করা হত।
এক গবেষণায় দেখা যায় যে, ২০০০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। বোমা হামলায় নিহত হয়েছে ১৩৬ জন, আহত হয়েছে ২ হাজার ৪৮৮ জন।
২০০৫ সালে জেএমবির ৬১টি জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থানের সর্ববৃহৎ আলামত দৃশ্যমান হয়।
২০১৬ সালের ১ জুলাইয়ে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় হামলায় ৫ জঙ্গিসহ ২৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের পেছনে মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করা সে সময়ে গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলার পর জঙ্গীবাদের নতুন ধারা দেখা গেছে। সেই হামলাকারীরা ছিল উচ্চশিক্ষিত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত, ও ধনী পরিবারের সন্তান।
২০১৩ সালের ৫ মে, বর্তমান সরকারের আমলে ধর্মভিত্তিক শক্তির সর্বপ্রথম ব্যাপক শক্তি প্রদর্শন দেখা যায়। ওইদিন রাজধানীর মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, দৈনিক বংলাসহ আশপাশের এলাকায় ব্যাপক দোকানপাট, ব্যাংকের বুথসহ নানা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় সহ তাণ্ডব চালায় হেফাজত ইসলামী। রাস্তার মাঝের শত শত গাছ কেটে ফেলা হয়, দিনভর তাণ্ডবের পর রাতে তারা অবস্থান নেয় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। যদিও রাতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সর্বাত্মক অ্যাকশানে হেফাজত নেতাকর্মীরা শাপলা চত্বর ছাড়তে বাধ্য হয়। বিশ্লেষকদের মতে, সেই রাতে হেফাজত কর্মীদের আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সর্বাত্মক অ্যাকশানে শাপলা চত্বর সরানো না গেলো তারা শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিত। এবং তাদের সঙ্গে সরাসরি যোগ দিত বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা, হয়তো এর মধ্যদিয়ে সরকারের পতনও হতে পারত।
মজার ব্যাপার হলো- এই ঘটনার কিছুদিন পরই অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে হেফাজতের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের একটা সম্পর্কও গড়ে ওঠে। ফল স্বরূপ সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা পেয়ে হেফাজত নেতারা চুপ হয়ে যায়, যেমন রাজনৈতিক ইস্যুতে সরকার তাদের বাঁধা দিলেও অরাজনৈতিক বিষয়ে বাঁধা দেয় না। এদেশের প্রধান বিরোধী
দল বিএনপি ও জামায়াতকে ঠেকানোর নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মাদ্রাসাভিত্তিক কিছু দল ও গ্রুপকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে প্রতিনয়ত আস্কারা দিয়ে চলেছে। প্রকৃত অর্থে এর মধ্যদিয়ে আসলে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কবর নিজেরাই খনন করছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে যেসব গ্রুপ ও দল বিরোধিতা করছে তারমধ্যে হেফাজত অন্যতম। হেফাজত ছাড়াও ধর্মভিত্তিক আরেকটি বড় গ্রুপ বা দল হলো ইসলামী আন্দোলন যার নেতৃত্বে আছেন চরমোনাইয়ের মরহুম পীরের ছেলে। উদাহরন স্বরূপ সম্প্রতি ফ্রান্সের বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বড় বড় শোডাউনসহ সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনার মধ্যদিয়ে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে।
ইতিহাস বলে, বাংলাদেশে ক্ষমতার স্বার্থে প্রধান দুই দলই ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গে রাখার চেষ্টা করছে সবসময়ে। আর এ সুবর্ন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দাক্ষিণপন্থী ইসলামীক জোটগুলি, রাষ্ট্রের অনেক সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিচ্ছে। আর এভাবেই বাড়ছে তাদের শক্তি ও সামর্থ।