Blog

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ: আমাদের করণীয়

 

 

সন্ত্রাসবাদ বিশ্বের প্রাচীনতম ঘটনাগুলোর একটি। কালের পরিক্রমায় এটি বিভিন্ন সময়ে নিজের রূপ বদলে ফিরে এসেছে নতুন আঙ্গিকে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক, মতাদর্শগত বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য সহিংসতা বা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জঙ্গিবাদ বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ক্রমাগত বৈশ্বিক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সময়ের সন্ত্রাসবাদ মূলত ৯/১১ ও আরব বসন্ত পরবর্তী ঘটনা। সন্ত্রাসবাদ এ দেশের সৃষ্ট কোন উপাদেয় না হলেও বিশ্বায়নের উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশ এটি লাভ করেছে। অতীতে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট সন্ত্রাসীদের সাথে যেমন কোল্ড ওয়ার সমসাময়িক সোসালিস্ট আন্দোলনের যোগসূত্র ছিল। তেমনি ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদীদের সাথেও সোভিয়েত-আফগান সংকট পরবর্তী মুজাহিদদেরও যোগসূত্র ছিল। বাংলাদশের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এটি বিভিন্ন সময়ে দেশে অনেক সন্ত্রাসী গোষ্ঠির উথান প্রত্যক্ষ করার পাশাপাশি সে সব গোষ্ঠির চূড়ান্ত পরিণতিও দেখেছে। এটি সম্ভব হয়েছে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের জনগনের সুস্পষ্ট অবস্থান, সরকারের সুনিদিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচক্ষণ ব্যবহারের কারণে।

প্রতিষ্ঠার পর হতে র‌্যাব তার ম্যানডেটের আলোকে বাংলাদেশে জঙ্গি দমনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এ দেশের প্রথম প্রজন্মের জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোর শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে হাল আমলের নিষিদ্ধ হওয়া জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র আমীরসহ শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে এই জঙ্গিগোষ্ঠিগুলোর নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দেয় র‌্যাব। হুজিবি’র মুফতি হান্নান, জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অপারেশনাল কমান্ডার মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল এবং ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলায় ব্যবহৃত বোমাগুলোর প্রস্তুতকারক জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। বিগত দশকে টার্গেট কিলিং এর মাধ্যমে ১৩ জন মুক্তমনা ব্লগার ও লেখককে হত্যার মধ্য দিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা আনসার আল ইসলামের আধ্যাতিক নেতা মাহমুদ হাসান গুনবিসহ অন্যান্য শীর্ষ নেতারাও র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় দেশে তেমন কোন জঙ্গি হামলা সংঘঠিত না হলেও ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার মাধ্যমে পুণরায় জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব ফুটে ওঠে। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় প্রাথমিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর সাথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে মূল অভিযান তৈরীর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে র‌্যাব। পরবর্তীতে আশুলিয়ায় হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জেএমবির প্রধান সারোয়ার জাহান, গাজীপুরে হলি আর্টিজান হামলার অর্থ, অস্ত্র ও বিষ্ফোরক সরবরাহকারী জেএমবির শুরা সদস্য মামুনুর রশীদ রিপন, চাপাইনবাবগঞ্জে হলি আর্টিজান মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি জেএমবি শীর্ষ নেতা শরিফুল ইসলাম খালিদসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান পরিচালনা করে। দেশ ব্যাপী বিভিন্ন স্থানে একের পর এক জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে বিপুল সংখ্যক জঙ্গিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব।

জঙ্গিবাদ দমনে দীর্ঘ এই পথ চলায় র‌্যাব বিভিন্ন সময়ে তার অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে এ দেশে জঙ্গিবাদকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা, জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের এর সাথে জড়ানোর কারণ, জঙ্গি সংগঠনগুলোর দ্বারা নতুন জঙ্গিদের নিয়োগ ও তাদের মৌলবাদী করার জন্য নির্ধারিত কৌশল, বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের দ্বারা নেওয়া জঙ্গিবাদের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং জঙ্গিবাদে জড়ানো সদস্যদের পরিবারগুলোর সমাজের মূলধারায় বসবাসের ক্ষেত্রে যেসকল চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় সেগুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করে।

মানুষ কেন জঙ্গিবাদে লিপ্ত হয়?

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে জড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ হল আদর্শগত বা ধর্মীয় প্রত্যয়। জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোর সাথে জড়ানো ব্যক্তিরা এমন চরমপন্থী গোষ্ঠীর প্রতি আকৃষ্ট হয় যেগুলো তাদের মতাদর্শগত বা ধর্মীয় বিশ্বাস পূরণের পথের প্রতিশ্রুতি দেয়। এই বিশ্বাসগুলো তাদের সহিংসতাকে একটি পবিত্র বা নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে দেখতে সহায়তা করে। এটি অনেক ক্ষেত্রে লোভনীয় হতে পারে। এছাড়ও এই মতাদর্শ ধর্ম, জাতীয়তাবাদ বা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মধ্যে নিহিত থাকতে পারে। যে ব্যক্তিরা বর্তমান আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে বিতৃষ্ণা বোধ করেন তারা জঙ্গিবাদী মতাদর্শের প্রতি বেশি সংবেদনশীল।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছু ব্যক্তি মানসিক দুর্বলতার কারণে জঙ্গিবাদের প্রতি সংবেদনশীল হতে পারে। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন যারা ইতিমধ্যেই জঙ্গিবাদে জড়িত তারা মানসিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিদের উপর সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ব্যক্তিগত অভিযোগ এবং প্রতিশোধ পরায়ণ ব্যক্তিদের তারা জঙ্গিবাদে জড়ানোর জন্য প্ররোচিত করতে পারে। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বা তাদের কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষতি, অবিচার বা সহিংসতার অভিজ্ঞতা মানুষকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে যা তাদের নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় বলে তারা বিশ্বাস করে। র‌্যাডিকেলাইজেশন প্রক্রিয়াটি অনেক সময় গোপনীয় সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে ঘটে, যেখানে এর ব্যবহারকারীরা জঙ্গিবাদের ধারনা প্রকাশ করে এবং বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা ক্যারিশম্যাটিক নেতাদের দ্বারা জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। অনেক সময় আর্থ সামাজিক কারণে মানুষ জঙ্গিবাদে জড়ায়। দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং মৌলিক মৌলিক সেবাগুলো লাভের অভাব মাঝে মাঝে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে যেখানে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো আর্থিক সহায়তা এবং সামাজিক অবস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি অর্থনৈতিক কষ্টের সম্মুখীন ব্যক্তিবর্গের নিকট একটি আকর্ষণীয় প্রলোভন হিসেবে কাজ করে। এছাড়াও অনেকে রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় হিসেবে সহিংসতাকে বেছে নেয়।

কিভাবে ও কাদের বেছে নেয়

জঙ্গি গোষ্ঠিগুলো নতুন সদস্যদের নিয়োগের জন্য বর্তমানে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে থাকে। তারা প্রায়ই নতুন সদস্যদের নিয়োগের জন্য বিদ্যমান সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোকে কাজে লাগায়। বন্ধুবান্ধব, পরিবারের সদস্য বা পরিচিতজন ও সমবয়সীদেরকে আদর্শিক প্রবৃত্তির মাধ্যমে জঙ্গিবাদে যোগদানের জন্য প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমানে ইন্টারনেট উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলির জন্য নতুন সদস্য নিয়োগ এবং তাদের উগ্রবাদী মনোভাবাপন্ন করার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম, অনলাইন ফোরাম এবং এনক্রিপ্ট করা মেসেজিং অ্যাপগুলি জঙ্গিবাদ প্রচার এবং সম্ভাব্য নিয়োগকারীদের সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি বিশাল প্লাটফর্ম। সেখানে তারা তাদের নিজস্ব ডিজাইনকৃত প্রোপাগান্ডা ও র‌্যাডিকেলাইজেশন ম্যাটেরিয়াল সমৃদ্ধ ভিডিও, পাম্পলেট ও বিভিন্ন অনলাইন সামগ্রী প্রচার করে যেগুলো জঙ্গিবাদের মতাদর্শ প্রচার করে। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপনের মাধ্যমে সহিংসতাকে মহিমান্বিত করে এবং তাদের উদ্দেশ্যকে ন্যায্যতা দিয়ে তাদের মতাদর্শের প্রতি নতুন সদস্যদের আগ্রহী করে তোলে। জঙ্গিগোষ্ঠিগুলো প্রায়শই সে সব দুর্বল ব্যক্তিদের টার্গেট করে, যাদের মধ্যে ব্যক্তিগত হিনমন্নতা, ট্রমা বা বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি রয়েছে। যা তাদের মূলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের তাদের আহবানের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে। এছাড়াও জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের সংগঠনে যোগদানের বিনিময়ে নিয়োগপ্রাপ্তদের প্রলুব্ধ করতে অর্থের প্রতিশ্রুতি, চাকরির সুযোগ বা তাদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেয়। কিছু ক্ষেত্রে, যে সকল অঞ্চলে জঙ্গিগোষ্ঠিগুলোর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেখানে প্রান্তিক বা সামাজিকভাবে দুর্বল ব্যক্তিদের জঙ্গিবাদে জড়ানোর জন্য বাধ্য করা হয় বা হুমকি দেওয়া হয়। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, কোন অপরাধের ফলে কারাগারে গিয়ে অনেক কয়েদিরা জঙ্গিবাদী মতাদর্শের সংস্পর্শে এসে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয় ও সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাহিরে এসে বিদ্যমান জঙ্গিদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে দেখা যায়।

Share on facebook
Facebook
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed By : F.A. Creative Firm Ltd.