মিডিয়া মানুষের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে। শাসকচক্র যখন ন্যায়বিচারে একচক্ষু হন- তখন মিডিয়া অন্য চোখ খুলে দেয়। আজকের বিশ্বে, সত্য নিউজ বের করে আনতে গিয়ে বিভিন্ন নির্যাতন ভোগ এমনকি খুন পর্যন্ত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। অনলাইনে নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি চলছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে ভয় দেখানো এবং নীরব করার লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এটিই এখন বিশ্বজুড়ে অনেক সাংবাদিকের জন্য বিপজ্জনক বাস্তবতা। কারণ ডিজিটাল যুগে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সুরক্ষা হ্রাস পেয়েছে, জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ অতি সম্প্রতি এমনটি বলেছেন।
‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পতন এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য হুমকির বৃদ্ধি একটি বিশ্বব্যাপী প্রবণতা। যা পিছিয়ে পড়া গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারী সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে তীব্রভাবে স্পষ্ট’- বলেছেন আইরিন খান; স্বাধীনতার অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষা সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক। মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ রহিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ‘মানবাধিকার, গণতন্ত্র, জনগণের অংশগ্রহণ এবং উন্নয়নের পরিণতি উদ্বেগজনক’- এও বলেছেন তিনি।
মানবাধিকার কাউন্সিলের কাছে একটি প্রতিবেদনে আইরিন খান বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি সাংবাদিকদের এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য দারুণ সুযোগ খুলে দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে গ্রাউন্ড ব্রেকিং অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, আন্তঃসীমান্ত সহযোগিতা, পাঠক-শ্রোতাদের সাথে সত্যতা যাচাই এবং তথ্য ও উৎসের ভান্ডারে প্রবেশাধিকার।
এরপরেও, খান উল্লেখ করেছেন যে- ডিজিটাল যুগও গুরুতর চ্যালেঞ্জ এবং হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে শুদ্ধ সাংবাদিকতায়। উদাহরণ হিসেবে, তিনি অনলাইন ও অফলাইনে হামলা এবং সাংবাদিকদের দায়মুক্তি দিয়ে হত্যার কথা উল্লেখ করেছেন। অপরাধীকরণ এবং সাংবাদিকদের হয়রানি; এবং ডিজিটাল কোম্পানিসহ রাষ্ট্রীয় এবং কর্পোরেট মিডিয়াতে স্বাধীনতা হরণ, কণ্ঠস্বর রোধ এবং মতামতের বহুত্বের অবক্ষয়ের কথা বলা হয়েছে।
‘সাংবাদিকদের হত্যা করে তাদের থামিয়ে দেওয়া সেন্সরশিপের সবচেয়ে জঘন্য রূপ’- প্রতিবেদনে এমনটিই বলা হয়েছে। খান বলেছেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হামলা প্রতিরোধ, তদন্ত এবং বিচারের বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক টাস্কফোর্সসহ দায়মুক্তি মোকাবিলার ব্যবস্থা বিবেচনা করার জন্য কাউন্সিলকে ভূমিকা নিতে হবে।
তিনি ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সায়েন্টিফিক অ্যান্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন (ইউনেসকো) দ্বারা সংকলিত একটি ডাটাবেস সাইটের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। যে রিপোর্টে উল্লেখ করেছে যে- ২০১৬-২০২১-এর মধ্যে কাজ করার সময় ৪৫৫ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। দশটি মামলার মধ্যে আটটির বেশি অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। প্রতিবেদনে নারী সাংবাদিকদের উপর অনলাইন আক্রমণের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেগুলো প্রায়শই জঘন্য, সমন্বিত এবং সেক্সুচাল হ্যারাসম্যান্ট সংশ্লিষ্ট। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু বা লিঙ্গ-অনুসরণকারী নারীদের লক্ষ্য করে। ‘এই ধরনের সহিংসতা খুব সত্যিকারের মানসিক আঘাত দেয়। জনস্বার্থের সাংবাদিকতাকে নিস্তেজ করে। নারীদের ক্যারিয়ারকে হত্যা করে এবং সমাজকে গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বঞ্চিত করে’, প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের শাস্তি দিতে এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা দমন করার জন্য আইনের অপব্যবহারের পুরোনো অভ্যাস। মানহানিকর আইন থেকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। কিছু রাষ্ট্র নতুন হিংস্রতার সাথে পুনরুজ্জীবিত করেছে এসব হীন কর্মকাণ্ড, প্রতিবেদনে এটা যোগ করা হয়েছে।
আইরিন খান ফিলিপাইনের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া রেসার মামলার উল্লেখ করেছেন। যিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি রদ্রিগো দুতের্তের সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের জন্য ফিলিপাইনে আইনি পদক্ষেপের শিকার হয়েছেন।
আইরিন খান ডিজিটাল যুগে স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ এবং মিডিয়ার অর্থনৈতিক সার্থকতার অবক্ষয়ের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন।
মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি দেশে, পাবলিক মিডিয়ার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মিডিয়ার পক্ষে ঝুঁকে থাকার প্রবণতা রয়েছে। খান আরও বলেছেন, গণমাধ্যমের কার্যকারিতা মানবাধিকারের বিষয়, শুধু অর্থনীতির প্রশ্ন নয়। ডিজিটাল যুগে বিজ্ঞাপনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায়িক মডেলের পতনের ফলে অনেক দেশে কর্মী ছাঁটাই এবং নিউজ আউটলেট বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রদানকারী এবং বিশেষ সংবাদ নির্মাতারা সাবস্ক্রিপশন, পাঠকদের অবদান এবং ভর্তুকি দিয়ে তা পরিচালনা করছেন। এতে অন্য অনেকগুলি মিডিয়া বিলুপ্তির মুখোমুখি হতে পারে।
“একটি বিশ্বে যেখানে বিভ্রান্তি, সংবাদ হিসেবে ক্রমবর্ধমানভাবে ছদ্মবেশিত হয় তখন সমাজে হতাশা বাড়ে। কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী নেতারা জনগণের অবিশ্বাসের বীজ বপন করার জন্য সাংবাদিক এবং মিডিয়া আউটলেটগুলিতে আক্রমণ করে। জনস্বার্থে উৎপাদিত সমালোচনামূলক স্বাধীন সাংবাদিকতা অপরিহার্য। অনেক দেশে এর অনুপস্থিতি বা পতন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর একটি বড়ো আক্রমণের প্রতিনিধিত্ব করছে”, রিপোর্টটিতে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।
এই তো গেল একটি দিক। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এখন হাতে হাতে মিডিয়া আসার ফলে বিভিন্ন ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবর যেভাবে ছড়াচ্ছে; এর প্রতিকারের উপায় কী! আমেরিকার বিভিন্ন জার্নাল সারসংক্ষেপে পাঁচটি করণীয় বিষয়ে একমত হয়েছে।
এগুলো হচ্ছে- (১) আপনি যখন সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকাবেন তখন তা গভীর বিবেচনা করে বিশ্বাস করুন।
(২) আপনার অনলাইন নেটওয়ার্কগুলিতে মিথ্যা তথ্য রাখবেন না। আপনি বিনয়ের সাথে যে ব্যক্তি এটি শেয়ার করেছেন তাকে এটি সরাতে বলতে পারেন।
(৩) প্ল্যাটফর্ম অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের মিথ্যা তথ্য রিপোর্ট করুন।
(৪) সন্দেহ হলে, শেয়ার করা তথ্য যাচাই করতে সময় নিন।
(৫) যারা মিথ্যা তথ্য শেয়ার করে, তাদের তাড়াতে আপনি আরও বেশি সোচ্চার হোন, এক্টিভিজম করুন।
গুজব এখন বেশি ছড়াচ্ছে অনলাইন মিডিয়ায়। কারণ এই ফিল্ডটি খুবই সস্তা হয়ে গিয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। এর পাশাপাশি তাহলে প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যত কী! অনেক মন্তব্যকারী ও বিশ্লেষক আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেছেন যে- ছাপা সংবাদপত্রের বয়স শেষ। বিজ্ঞাপনের আয় কমে যাওয়া এবং অনলাইনে ক্রমবর্ধমানভাবে স্থানান্তরিত হওয়াও এর কারণ। পাঠক কমে যাওয়াসহ শিল্পের ব্যাপক উন্নয়নগুলি সংবাদপত্র শিল্পের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে, এরূপ বলা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যাপস্টোন প্রকল্প’টি একটি গভীর পর্যালোচনা, ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের বক্তৃতাগুলির একটি সিরিজ এবং ছয়টি দেশের প্রকাশক এবং সম্পাদকদের সাথে ২৪টি সাক্ষাৎকার পরিচালনার মাধ্যমে সংবাদপত্র শিল্পের পতনের এই বৈশিষ্ট্যটি কতটা সঠিক তা প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে- মুদ্রণ শিল্পের মধ্যে স্পষ্টতই উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে অনলাইন বিষয়বস্তু নগদীকরণের প্রচেষ্টার চারপাশে এবং প্রিন্ট থেকে বিজ্ঞাপনের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব প্রতিস্থাপনের জন্য। রাজস্বের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার জন্য, শিল্পের পতনকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। সংবাদ সংস্থাগুলি রূপান্তর এবং অভিযোজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু, সমীক্ষটি বলছে যে সংবাদপত্রের ক্রমাগত পতনের বর্ণনাটি বেশিরভাগই পশ্চিমাকেন্দ্রিক এবং এটি আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে বিবেচনা করে না। সত্য হচ্ছে- অনেক উদীয়মান দেশে, মুদ্রণ সংবাদপত্র বিক্রি শক্তিশালী এবং ক্রমবর্ধমান।
সাধারণত মিডিয়াকে এখন দুইভাবে বিভক্ত করা হচ্ছে। এক- ঐতিহ্যবাহী মিডিয়া এবং দুই- নতুন মিডিয়া (যেমন: ব্লগ, ভ্লগ, পডকাস্ট, ওয়েবসাইট ইত্যাদি)। কিন্তু সব মিডিয়াই শক্তির জায়গায় এক। মিডিয়ার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মনোভাব এবং আচরণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। এইভাবে, সামাজিক নিয়ম যা লিঙ্গ সহিংসতাকেও প্রভাবিত করে এবং উৎসাহিত করে। পূর্ববর্তী গবেষণা বলছে, মিডিয়া দুটি প্রভাবের মাধ্যমে প্রভাবিত করে। তা হলো- ব্যক্তিগত বা প্রত্যক্ষ প্রভাব (ব্যক্তিগত) বা সামাজিক বা পরোক্ষ প্রভাব (পাবলিক)। ব্যক্তিগত প্রভাবে, নতুন নিয়ম সম্পর্কে মিডিয়া তথ্য ব্যক্তিদের সেগুলি গ্রহণ করতে প্ররোচিত করতে পারে। সামাজিক প্রভাবে, তথ্য একটি আদর্শের সাধারণ জ্ঞান তৈরি করে এবং সামাজিক সমন্বয় বাড়ায়। কারণ ব্যক্তিরা আরও সহজে তথ্য গ্রহণ করে যদি তারা বিশ্বাস করে যে- অন্যরাও এটি গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, মিডিয়ার সামাজিক প্রক্রিয়া নারীর বিরুদ্ধে সহিংস মনোভাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত প্রক্রিয়ার চেয়ে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা নতুন মোড় নিয়েছে। সংবাদপত্র গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম, এখনো পর্যন্ত বলিষ্ঠতম মাধ্যম রূপেই স্বীকৃত। সমাজে রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র প্রভৃতির বিস্তার ও প্রভাব যতই বাড়ুক না কেন সংবাদপত্রের গুরুত্ব ও প্রভাব কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্রও ক্ষুণ্ন হয়নি। তবে ইলেকট্রনিক মাধ্যম এবং তারপর ডিজিটাল মাধ্যমও এখন অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক এবং বিশেষ করে ডিজিটাল মাধ্যম এখন নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আর এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো ফেক নিউজ বা অসত্য খবরের প্রচার। এ ধরনের অসত্য খবরের মোকাবিলা মস্ত বড়ো সমস্যা, বিশেষত সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দেওয়ার জন্য, সন্ত্রাসের বীজ বপন করতে কায়েমি স্বার্থ যখন এ ধরনের অসত্য প্রচার ডিজিটাল বা সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যবহার করা হয় তখন সাংবাদিকরা তার মোকাবিলা করবে কীভাবে? বাংলাদেশের ছবি বলে ফেসবুক টুইটে দেখানো হচ্ছে যে ছবি দেখা যাচ্ছে তা আদৌ বাংলাদেশেরই নয়। হয়তো আনা হয়েছে আফ্রিকার কোনো দেশ থেকে।
লেখাটির শেষে এসে, ২০২৩ সালে নিহত সাংবাদিকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে চাই। বিশ্বব্যাপী ২০২৩ সালে মোট ৯৯ জন সাংবাদিক নিহত হন। এর মধ্যে ৭২ জন ফিলিস্তিনি। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের প্রতিবেদন করতে গিয়ে তারা নিহত হন। বিশ্বব্যাপী নিহত সাংবাদিকদের প্রায় ৭৫ শতাংশই ফিলিস্তিনি। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) বলছে, গত এক দশকে এ ধরনের হত্যা গণমাধ্যমের জন্য মারাত্মক হুমকি।
গত ডিসেম্বরে সংস্থাটি বলছে, গাজায় কাজ করার সময় ৭৭ সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭২ জন ফিলিস্তিনি, তিনজন লেবানিজ ও দুইজন ইসরায়েলি।