Blog

শিক্ষার্থীরা যে কারণে ধর্মীয় উগ্রচিন্তার দিকে ঝুঁকছে ,,,

ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় উগ্র মতাদর্শে প্রভাবিত হচ্ছেন। অনলাইনে উগ্রতার চর্চা করে জঙ্গি তৎপরতায় অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন। অংশ নিচ্ছেন জঙ্গি কর্মকাণ্ড ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। দেশের সরকারি চারটি ও বেসরকারি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।

গবেষকরা বলেন, একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৩ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্ত থাকছেন। ফলে তাকে সে মাধ্যমে প্রভাবিত করা সহজ। অনলাইনে ধর্মের নামে উগ্রবাদের নানা ফাঁদ পাতা আছে। সুষ্ঠু সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কমে আসায় পরমতসহিষ্ণুতা, অন্যের মতামত ও বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ পোষণের চর্চা অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে গড়ে ওঠছে না। নিজের ধর্মকেও তারা ঠিকমতো জানতে পারছেন না। উগ্রবাদ ও ধর্মের মৌলিক চিন্তার বিষয়ে তারা বিভ্রান্ত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জঙ্গি, উগ্রবাদীদের ওয়েবসাইট, ইন্টারনেট টিভি, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলগুলো শিক্ষার্থীকে উগ্রপন্থার দিকে ধাবিত করছে। ভাত-কাপড়ের জন্য নয়, ধর্মের অপব্যাখ্যা ও মগজধোলাইয়ের কারণে তারা বিপথগামী হচ্ছেন। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদদের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা তুলনামুলক বেশি।

বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকে নেতিবাচকভাবে দেখেন। এ চর্চার ধারণাকে তারা ‘অনৈসলামিক’ মনে করেন। এসব শিক্ষার্থীকে ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যালঘু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই ব্যবহার করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। ‘ইসলাম অবমাননার’ কথিত অভিযোগ তুলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান শিক্ষককে গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুত করা, বিভিন্ন সাজা দেওয়ার ঘটনা দেশে ক্রমেই বাড়ছে। স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় ও প্রশাসনের এক ধরনের প্রশ্রয় থাকায় ধর্মীয় কৌশলকে কাজে লাগাচ্ছে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীগুলো।

এতে ‘অভিযুক্ত’ শিক্ষকসহ তাঁর পরিবার নতুন ঝুঁকির কবলে পড়ছে। সবশেষ মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তির’ অভিযোগে মামলা ও তাঁর কারাবাস দেশের সংখ্যালঘু শিক্ষকদেরকে আতঙ্কিত করে তোলেছে।

তাঁরা বলেন, হৃদয় মণ্ডলকে শ্রেণিকক্ষে ফাঁসানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এভাবে যে কাউকে ফাঁসানো সম্ভব। তিনি বলেছেন, ধর্ম বিশ্বাসের আর বিজ্ঞান প্রমাণের বিষয়। এটা যে কোনো শিক্ষকেরই বক্তব্য।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে অনলাইনে জঙ্গিবাদ উসকে দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ কার্যক্রম চলছে যুক্তরাজ্যের লন্ডন ও পাকিস্তান থেকে। একটি সাইট বন্ধ করলে নতুন সাইট চালু করছে প্রযুক্তি প্রশিক্ষিত জঙ্গি মনস্করা।

গবেষণা বলছে, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা বলা, পোশাক পরা ও দিবস উদ্যাপনের মধ্যে উগ্রবাদের প্রভাব প্রকট। ওয়াহাবি মতাদর্শ অনুসরণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। বাঙালি সংস্কৃতিকে তারা ‘হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি’ মনে করেন। মাতৃভাষার বদলে ভাববিনিময়ে তারা অযথা আরবি শব্দ ব্যবহার করেন। এমন নানা বিষয় উগ্রবাদের প্রতি আকর্ষণ বাড়াচ্ছে তাদের।

প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়েও তাদের ‘ক্ষোভ’ আছে। দেশে কোনো ‘নিয়মকানুন ও ব্যবস্থা’ কাজ করে না বলে তারা মনে করছেন। কেউ পড়াশোনা শেষ করে সঠিক উপায়ে চেষ্টা করে চাকরি পাবেন, সে ভরসা নেই বলে তাদের ধারণা।

শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর না হওয়া, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকা, শিক্ষা কার্যক্রম সঠিক পথে পরিচালিত না হওয়া আর উদার সংস্কৃতির চর্চা না থাকায় শিক্ষার্থীরা উগ্রতায় জড়াচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জঙ্গিবাদ-বিরোধী সেল খোলার নির্দেশ দিলেও তা যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিশেষ নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া থাকলেও তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর বেশি নজর রাখেন।

ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী এসব প্রসঙ্গে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার অভাব আছে। ফলে সমাজে নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয় ঘটছে। সুষ্ঠু রাজনীতি ও সংস্কৃতির চর্চা না থাকা আর ধর্মান্ধতার কারণে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে বিপথগামী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।’

শিক্ষার্থীদের উগ্রতার চর্চার গবেষণার বিষয়ে এর অন্যতম গবেষক ও ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইম‌তিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সম্ভাষণ ও বিদায়সহ দৈনন্দিন নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কথাবার্তায় আরবি শব্দের ব্যবহার বাড়ছে। নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে হিজাব, নেকাব পরা ও ছেলেদের মধ্যে ওয়াহাবি মতাদর্শ অনুসরণকারীদের মতো গোড়ালির ওপর প্যান্ট পরার প্রবণতা বাড়ছে।’

ঢাবির গবেষণা প্রবন্ধে পাঁচটি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- উগ্রবাদবিরোধী মতবাদকে শক্তিশালী করতে হবে। কোনোভাবেই উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক রং দেওয়া যাবে না। ফেসবুকে যেসব গ্রুপ উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে, তাদের পাল্টা মতবাদ তৈরি করতে হবে।

পাঠ্যপুস্তকে উগ্রবাদবিরোধী উপাদান যুক্ত করা যেতে পারে, যাতে শিক্ষার্থীরা বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করতে পারেন। আরবি-ধর্মীয় বইগুলোর প্রচুর বাংলা অনুবাদ করতে হবে, যাতে মানুষ ধর্মের বিষয়গুলো নিজে নিজেই নিজের ভাষায় জানতে, বুঝতে পারে।

Share on facebook
Facebook
Share on telegram
Telegram
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

Developed By : F.A. Creative Firm Ltd.