সহিংস উগ্রবাদ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার নাম। সারা বিশ্বের মানুষ আজ এটি নিয়ে উৎকণ্ঠিত এবং উদ্বিগ্ন। এর ভয়ংকর ছোবলে বিশ্ব আজ ক্ষতবিক্ষত। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আমাদের সমাজে যে শান্তি ও সম্প্রীতি বিরাজমান ছিল, তা বিনষ্ট করছে সহিংস উগ্রবাদ; আমাদের মধ্যে তৈরি করছে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব। দিন দিন এর মাত্রা যতই বাড়ছে, ততই সমাজে মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত, সংঘাত ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। এটি আজ একক কোনো রাষ্ট্রের সমস্যা নয়। বরং এটি পুরো বিশ্বের সমস্যা। এর প্রত্যক্ষ শিকার হচ্ছে যুবসমাজ। আমাদের উদীয়মান তরুণসমাজ সহিংস উগ্রবাদের শিকার হয়ে আমাদের ভবিষ্যতকে করছে হুমকির সম্মুখীন।
সাধারণত উগ্রবাদ মানে জোর করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির মতবাদ অপরের ওপর চাপিয়ে দেওয়াকে বোঝায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় চরম বিশ্বাস ধারণ করা, অন্যের মতামত ও বিশ্বাসের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব না দেওয়া এবং যে কোনো উপায়ে নিজের মতামত ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার নামই উগ্রবাদ। উগ্রবাদের সাথে সহিংসতার রয়েছে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। বর্তমান সময়ের সকল সহিংসতার সাথে উগ্রবাদের সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীত। কখনো সেটা রাজনৈতিক, না হয় ধর্মীয় বা অন্যান্য। যার ফলে উগ্রবাদ আজ সহিংস উগ্রবাদে রূপ নিয়েছে।
ঠিক কী কারণে সহিংস উগ্রবাদের সৃষ্টি হয় তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে নিজের মতকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকেই শুরু হয় সহিংস উগ্রবাদের। আজ পর্যন্ত এর একক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং এর পেছনে বহুমাত্রিক কারণ বিদ্যমান। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, ধর্মীয় ইত্যাদি নানা বিষয় সহিংস উগ্রবাদকে উসকে দেয়। রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে কলহ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিলে অনেক সময় সহিংস উগ্রবাদের জন্ম হয়। তা ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে গণতন্ত্র চর্চার অভাবে দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মাঝে চাপা ক্ষোভ তৈরি করে, যা একসময় সহিংসতায় রূপ নিয়ে থাকে। সহিংস উগ্রবাদের আর একটি অন্যতম কারণ ধর্ম। ধর্মকে ঘিরে সহিংসতা অতি প্রাচীন বিষয়। এক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ড চার্চ কাউন্সিলের আন্তধর্মীয় সংলাপ বিভাগের অধ্যাপক রেভারেন্ড মার্টিন অধিকারি বলেন, ধর্মকে ঘিরে সহিংসতা পৃথিবীর আদি ইতিহাসেও আছে। ধর্ম তখনো জাতিগত বিভেদ তৈরি করেছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক বছরের শান্তির বিপরীতে ১৩ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছে। আবার মানুষের দশ শতাংশ সমস্যা তৈরি হয়েছে মতের অমিলের কারণে। বাকি নব্বই শতাংশ সৃষ্টি নিজের মতকে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা থেকে।
আর ধর্মকে ঘিরে এসব সহিংসতা মূলত ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার অভাব ও পরকালে সহজে স্বর্গ প্রাপ্তির প্রত্যাশা ইত্যাদির কারণে হয়ে থাকে। স্বার্থান্বেষী মহলের নানা আকর্ষনীয় প্রলোভনও সহিংস উগ্রবাদে প্রলুব্ধ করতে পারে।
সহিংস উগ্রবাদের আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ-আইনের শাসন না থাকা। কারণ বিচার ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে তখনই সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেকে তখন সে সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। একটি শ্রেণি পরিস্থিতির বিকৃত ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করে। মতাদর্শগত ভিন্নতাও সহিংস উগ্রবাদের কারণ বলে অনেকে মনে করেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রদর্শন কিংবা কোনো সেবা বা অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য দেখা দিলেও তা সহিংস উগ্রবাদে রূপ নিতে পারে। এমনকি হতাশা, বেকারত্ব, বঞ্চনা, বিষণ্নতা, দুর্নীতি ইত্যাদি যখন চরম মাত্রায় পৌঁছায়, তখন এগুলো সহিংস উগ্রবাদের দিকে ধাবিত করে। অধিকাংশক্ষেত্রে দেখা যায় যোগ্যতা, দক্ষতা ও পছন্দ অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, পিতা-মাতা কিংবা পরিবারের সাথে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় না হওয়া, পিতা-মাতার উচ্চ প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়া ইত্যাদি যুবসমাজের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। যা তাদেরকে সহিংস উগ্রবাদসহ নানা অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হতে সাহায্য করে। সহনশীলতা মানুষের অন্যতম একটি পরম গুণ। এটি মানুষকে ধীর ও শান্ত থাকতে সাহায্য করে। সহনশীলতা পরাজয় বা মানুষের যেকোনো বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে শেখায়। তাই সহনশীলতার অভাব দেখা দিলে সহিংস উগ্রবাদের সৃষ্টি হতে পারে। মানসম্মত ও প্রাসঙ্গিক শিক্ষার অভাবও সহিংস উগ্রবাদের জন্ম দেয় কখনো কখনো।
সহিংসতা কিংবা উগ্রবাদ কোনোটিই সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়, বরং তা সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর। এর কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের সবাই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু সমাজের ঠিক কারা এর শিকার হয়, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না, তবে যে বা যারাই এর শিকার হোক না কেন তার প্রভাব সমাজের অন্যান্য সকল জায়গায় প্রতীয়মান হয়। সাধারণত জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণ, উদীয়মান যুবশ্রেণি বিশেষ করে বেকার এবং ঝরে পড়া যুবগোষ্ঠী ও ছাত্র-ছাত্রীরা, পরিবার, সমাজ এবং সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রভৃতি সহিংস উগ্রবাদের শিকার হয়ে থাকে।
সহিংস উগ্রবাদ একটি জাতির সামনে এগোবার পথকে রুদ্ধ করে দেয়। সম্প্রীতি ও শান্তির মাঝে টেনে দেয় একটা বিভাজন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, সম্প্রদায় ইত্যাদির মধ্যে অশান্তির দেয়াল তুলে দিয়ে সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, রক্তপাত বা হানাহানির। তাই সহিংস উগ্রবাদ নিরসনে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যেহেতু এটি একক কোনো রাষ্ট্রের সমস্যা নয়, সেজন্য সকল দেশ ও জাতিকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে এটি প্রতিরোধে আমাদের যুবসমাজকে কাজে লাগাতে হবে। সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধের যাত্রা শুরু হতে হবে পরিবার থেকেই। পরিবার হল সবচেয়ে প্রাচীন ও কার্যকরী সামাজিকীকরণের মাধ্যম। একজন ব্যক্তির নিরাপত্তা ও ভরসার নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল তার পরিবার। তাই পিতা-মাতা ও পরিবারের সাথে সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি করতে হবে। পরিবার থেকে সন্তানদের মূল্যবোধ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্প্রীতির শিক্ষা দিতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কখন, কী করে, কার সাথে মেশে, বাবা-মাকে তা খেয়াল রাখতে হবে। তাদেরকে সময় দিতে হবে। সাথে সাথে প্যারেন্টিংয়েও পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের সমাজে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার মানুষ বাস করে। মানুষের মাঝে এই যে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য, যা সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করে, তাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক ও মানবিক কাজ যেমন- মুমূর্ষু /রোগীকে রক্ত দেওয়া, অসহায় মানুষের সাহায্য করা, দুর্যোগ কবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়া, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচীতে অংশ নেওয়া ইত্যাদি মানবীয় কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এসব কাজ মানুষের সুস্থ্য মনের বিকাশে সাহায্য করে। সহনশীল হতে হবে। কারণ, দেখা যায় যারা উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়েছে, তারা যে স্থান থেকেই আসুক না কেন, তাদের অন্তত একটি জায়গায় মিল রয়েছে। আর তা হলো তাদের সহনশীলতার অভাব আছে। আমাদের মাঝে দিন দিন অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে বড় সহিংসতা ঘটাতেও আমরা দ্বিধা করছি না। তাই আমাদের সহনশীলতা বাড়াতে হবে।
একজন মানুষের মধ্যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি ভাব থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষকে উদার হতে শেখায়; তাই সবাইকে বিশেষকরে যুবসমাজকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ বাড়াতে হবে। বলা হয়ে থাকে ‘সৎ সঙ্গে সর্গ বাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’। তাই সঙ্গ বা বন্ধু নির্বাচনে যেমন সতর্ক হওয়া জরুরি, তেমনি কোনো বন্ধু বা সঙ্গীকে ভুল পথে যেতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারকে জানাতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য কোনো ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী বা শ্রেণির মানুষের প্রতি সহিংস ও উগ্র আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো প্রকার জাগতিক বা পারলৌকিক প্রলোভনে আকৃষ্ট হওয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, খেলাধুলা ইত্যাদি মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এজন্য নিজ নিজ এলাকার সমবয়সী যুবকদের সংগঠিত করে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। সামাজিক সম্প্রীতিকে জীবনের একটি দর্শন হিসেবে নিতে হবে। অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে এবং সবার বিশ্বাস ও মত মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সবাইকে বিশেষকরে যুবসমাজকে মনে প্রাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের জীবনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো গুজব ছড়ানো কিংবা উস্কানীমূলক এমন কোনো বিষয় পোস্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির মাঝে সংঘাত সৃষ্টি করে। প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিতে হবে। অন্যান্য ধর্ম ও মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের সাথে বৈষম্যহীন আচরণ করতে হবে। প্রত্যেককে নিজ নিজ ধর্ম সঠিকভাবে চর্চা করতে হবে। মাদককে না বলাসহ সকল অসামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকতে হবে। সুকুমার বৃত্তি ও সৃজনশীল কাজের চর্চা করতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকক্ষেত্রে সকলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে যুবসমাজকে সহিংসতা ও অপরাধমূলক কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে ফোরাম করতে হবে। যেখানে সব ধর্মের, বর্ণের ও মতের মানুষ একসাথে কাজ করবে। তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভারসাম্য বজায় থাকবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, সহিংস উগ্রবাদ সমাজের একটি ক্যান্সার। এটি পুরো সমাজকে আজ গ্রাস করে ফেলছে। বিশ্বের তাবৎ মানুষ আজ এর তাণ্ডবে আতংকিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত। এটি শুধু আমাদের দেশে নয় বরং সারা বিশ্বের জন্য একটি অশনিসংকেত। এটি আামাদের শান্তি ও সম্প্রীতির সমাজকে দ্বিধাবিভক্ত করছে। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে আমাদের তরুণ যুবসমাজের ওপর, যাদের ওপর একটি জাতির উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। তাই আমাদের যুবসমাজকে যদি আমরা সহিংস উগ্রবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারি তবে আমাদের ভবিষ্যত হবে অন্ধকারময়। এখনই সময় সহিংস উগ্রবাদকে রুঁখে দেওয়ার। এক্ষেত্রে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই আমরা সহিংস উগ্রবাদমুক্ত শান্তিময় একটি আদর্শ সমাজ উপহার দিতে পারব।